সপ্তদশ অধ্যায়
শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ! যারা শাস্ত্রীয় বিধান পরিত্যাগ করে শ্রদ্ধা সহকারে দেব-দেবীর পূজা করে, তাদের সেই নিষ্ঠা কি সাত্ত্বিক, রাজসিক না তামসিক?।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন-দেহীদের স্বভাব-জনিত শ্রদ্ধা তিন প্রকার- সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী। এখন সেই সম্বন্ধে শ্রবণ কর।
অনুবাদঃ হে ভারত! সকলের শ্রদ্ধা নিজ-নিজ অন্তঃকরণের অনুরূপ হয়। যে যেই রকম গুণের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেই রকম শ্রদ্ধাবান।
অনুবাদঃ সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা দেবতাদের পূজা করে, রাজসিক ব্যক্তিরা যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজা করে এবং তামসিক ব্যক্তিরা ভূত ও প্রেতাত্মাদের পূজা করে।
অনুবাদঃ দম্ভ ও অহঙ্কারযুক্ত এবং কামনা ও আসক্তির প্রভাবে বলান্বিত হয়ে যে সমস্ত অবিবেকী ব্যক্তি তাদের দেহস্থ ভূতসমূহকে এবং অন্তরস্থ পরমাত্মাকে ক্লেশ প্রদান করে শাস্ত্রবিরুদ্ধ ঘোর তপস্যার অনুষ্ঠান করে, তাদেরকে নিশ্চিতভাবে আসুরিক বলে জানবে।
অনুবাদঃ সকল মানুষের আহারও তিন প্রকার প্রীতিকর হয়ে থাকে। তেমনই যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ। এখন তাদের এই প্রভেদ শ্রবণ কর।
অনুবাদঃ যে সমস্ত আহার আয়ু, সত্ত্ব, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি বর্ধনকারী এবং রসযুক্ত, স্নিগ্ধ, স্থায়ী ও মনোরম, সেগুলি সাত্ত্বিক লোকদের প্রিয়।
অনুবাদঃ যে সমস্ত আহার অতি তিক্ত, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, অতি তীক্ষ্ম, অতি শুষ্ক, অতি প্রদাহকর এবং দুঃখ, শোক ও রোগপ্রদ, সেগুলি রাজসিক ব্যক্তিদের প্রিয়।
অনুবাদঃ আহারের এক প্রহরের অধিক পূর্বে রান্না করা খাদ্য, যা নীরস, দুর্গন্ধযুক্ত, বাসী এবং অপরের উচ্ছিষ্ট দ্রব্য ও অমেধ্য দ্রব্য, সেই সমস্ত তামসিক লোকদের প্রিয়।
অনুবাদঃ ফলের আকাঙ্ক্ষা রহিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক শাস্ত্রের বিধি অনুসারে, অনুষ্ঠান করা কর্তব্য এভাবেই মনকে একাগ্র করে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তা সাত্ত্বিক যজ্ঞ।
অনুবাদঃ হে ভরতশ্রেষ্ঠ! কিন্তু ফল কামনা করে দম্ভ প্রকাশের জন্য যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাকে রাজসিক যজ্ঞ বলে জানবে।
অনুবাদঃ শাস্ত্রবিধি বর্জিত, প্রসাদান্ন বিতরণহীন, মন্ত্রহীন, দক্ষিণাবিহীন ও শ্রদ্ধারহিত যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলা হয়।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান, ব্রাক্ষণ, গুরু ও প্রাজ্ঞগণের পূজা এবং শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা-এগুলিকে কায়িক তপস্যা বলা হয়।
অনুবাদঃ অনুদ্বেগকর, সত্য, প্রিয় অথচ হিতকর বাক্য এবং বৈদিক শাস্ত্র পাঠ করাকে বাচিক তপস্যা বলা হয়।
অনুবাদঃ চিত্তের প্রসন্নতা, সরলতা, মৌন, আত্মনিগ্রহ ও ব্যবহারে নিষ্কপটতা-এগুলিকে মানসিক তপস্যা বলা হয়।
অনুবাদঃ ফলাকাঙ্ক্ষা রহিত মানুষের দ্বারা পরম শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত ত্রিবিধ তপস্যাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলা হয়।
অনুবাদঃ শ্রদ্ধা, সম্মান ও পূজা লাভের আশায় দম্ভ সহকারে যে তপস্যা করা হয়, তাকেই এই জগতে অনিত্য ও অনিশ্চিত রাজসিক তপস্যা বলা হয়।
অনুবাদঃ মূঢ়োচিত আগ্রহের দ্বারা নিজেকে পীড়া দিয়ে অথবা অপরের বিনাশের জন্য যে তপস্যা করা হয়, তাকে তামসিক তপস্যা বলা হয়।
অনুবাদঃ দান করা কর্তব্য বলে মনে করে প্রত্যুপকারের আশা না করে উপযুুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে এবং উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক দান বলা হয়।
অনুবাদঃ যে দান প্রত্যুপকারের আশা করে অথবা ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং অনুতাপ সহকারে করা হয়, সেই দানকে রাজসিক বলা হয়। অশুচি স্থানে, অশুভ সময়ে, অযোগ্য পাত্রে, অনাদরে এবং অবজ্ঞা সহকারে যে দান করা হয়, তাকে তামসিক দান বলা হয়।
অনুবাদঃ ওঁ তৎ সৎ- এই তিন প্রকার ব্রহ্ম-নির্দেশক নাম শস্ত্রে কথিত আছে। পুরাকালে সেই নাম দ্বারা ব্রাহ্মণগণ, বেদসমূহ ও যজ্ঞসমূহ বিহিত হয়েছে।
অনুবাদঃ সেই হেতু ব্রহ্মবাদীদের যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও ক্রিয়াসমূহ সর্বদাই ওঁ এই শব্দ উচ্চারণ করে শাস্ত্রের বিধান অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
অনুবাদঃ মুক্তিকামীরা ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে ‘তৎ’ এই শব্দ উচ্চারণ-পূর্বক নানা প্রকার যজ্ঞ, তপস্যা, দান আদি কর্মের অনুষ্ঠান করেন।
অনুবাদঃ হে পার্থ! সৎভাবে ও সাধুভাবে ‘সৎ’ এই শব্দটি প্রযুক্ত হয়। তেমনই শুভ কর্মসমূহে ‘সৎ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যজ্ঞে, তপস্যায় ও দানে ‘সৎ’ শব্দ উচ্চারিত হয়। যেহেতু ঐ সকল কর্ম ব্রহ্মোদ্দেশক হলেই ‘সৎ’ শব্দে অভিহিত হয়।
অনুবাদঃ হে পার্থ! অশ্রদ্ধা সহকারে হোম, দান বা তপস্যা যা কিছু অনুষ্ঠিত হয়, তাকে বলা হয় ‘অসৎ’। সেই সমস্ত ক্রিয়া ইহলোকে ও পরলোকে ফলদায়ক হয় না।
ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে ‘শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগো’ নাম সপ্তদশোঽধ্যায়ঃ
🙏🏼
শ্রীমদ্ভগবত গীতার সপ্তদশ অধ্যায় – শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ এর সার-সংক্ষেপ
এই জগৎ-সংসার পরিচালিত হয় তিনটি গুণের দ্বারা। সত্ত্ব, রজো এবং তামো- এই তিনটি গুণই সকল কাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এমনকি মানুষের যে শ্রদ্ধা ভক্তি তাও গুণানাসারে ত্রিবিধ হয়ে থাকে। এই অধ্যায়ে গুণানুসারে ত্রিবিধ শ্রদ্ধার বিভাগ পূর্বক তাদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিধায় এই অধ্যায়ের নাম হয়েছে ‘শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ’। আটাশটি শ্লোকবিশিষ্ট এই অধ্যায়টি শুরু হয়েছে অর্জুনের উক্তি দিয়ে। শুরুতেই অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণসমীপে জানতে চাইলেন যে, যে সকল মানুষ শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করে শ্রদ্ধা যুক্ত হয়ে দেবাদির পূজার্চনা করে তাদের এনিষ্ঠা কোন প্রকারের? অর্থাৎ উহা কি সাত্ত্বিক, রাজসিক অথবা তামসিক। অর্জুনের এ জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন যে, শাস্ত্রীয় সংস্কার ব্যতীত মানুষের স্বভাবজাত শ্রদ্ধা সাত্ত্বিকী, রাজসী এবং তামসী – এই তিন প্রকারের হয়ে থাকে। তিনি বিস্তারিতভাবে বলতে লাগলেন- সকল মানুষের শ্রদ্ধা তাদের অন্তঃকরণ অনুযায়ী হয়। মানুষ শ্রদ্ধাময়। তাই যে ব্যক্তি যেমন শ্রদ্ধাবিশিষ্ট সে স্বরূপত তেমনি হয়ে থাকে। যারা পরমায়ু লাভের জন্য সংযমের সাথে সুখভোগ করেন, পুষ্টিকর খাদ্য আহার করেন এবং শরীরকে সুস্থ ও নীরোগ রাখতে সচেষ্ট হন তার সাত্ত্বিক। উগ্রবস্তু ও উগ্রভাব রাজসিক ব্যক্তিগণের প্রিয়। তামসিক ব্যক্তিগণ উচ্ছিষ্ট দ্রব্য ভোজন, বাসী খাদ্য গ্রহণ এবং পরিষ্কার বসন ভূষণ পরিধান করা পছন্দ করে। মানুষ ধর্মানুশীলনের উপায় হিসেবে যজ্ঞাদি করে থাকে। কিন্তু সে যজ্ঞ ও ত্রিবিধ হয়ে থাকে। শাস্ত্রবিধি সম্মতভাবে এবং ফলাকাংখা না করে যে যজ্ঞ করা হয় তা সাত্ত্বিক যজ্ঞ। আর ফলাকাংখা নিয়ে এবং দম্ভ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে যে যজ্ঞ করা হয় তা রাজসিক যজ্ঞ। অপরপক্ষে শাস্ত্রবিধি না মেনে শ্রদ্ধাবিহীনভাবে দক্ষিণা ব্যতিরেকে যে যজ্ঞ করা হয় তা তামসিক যজ্ঞ। অতপর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আরও বললেন যে, মানুষের তপস্যাও দু’প্রকারের। যথা- শারীরিক ও মানসিক। পূজা আচারে শুচিতা, ব্রহ্মচর্য পালন এবং অহিংসা- এসব হচ্ছে শারীরিক তপস্যা। পক্ষান্তরে সত্যবাদিতা, সরলতা, মনঃসংযমতা- ইত্যাদি হচ্ছে মানসিক তপস্যা। যারা ফলের আশা না করে শ্রদ্ধাসহকারে তপস্যা করেন তারা সাত্ত্বিক। আর যারা ফল ও যশের আশায় তপস্যা করে তারা রাজসিক। এছাড়া যারা স্বার্থপর বশে অন্যের অনিষ্ট সাধনের উদ্দেশ্যে তপস্যা করে তারা তামসিক। অতপর শ্রীকৃষ্ণ গুণভেদে ‘দান’ ও যে ত্রিবিধ হয়ে থাকে তা ব্যাখা করলেন। তিনি বললেন- সাত্ত্বিক দাতাগণ দেশ কাল পাত্র বিচার না করে এবং কোনরূপ প্রত্যুতপকারের আশা না করে দান করেন। কিন্তু যারা প্রত্যুপকারের আশায় দান করেন তারা রাজসিক দাতা। আর যারা দেশ, কাল, পাত্র বিবেচনাপূর্বক অবহেলায় দান করেন তারা তামসিক দাতা বলে কথিত হয়। পরিশেষে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন- হে পার্থ! হোম, দান, তপস্যা আর অন্য যা কিছু কৃতকর্ম অশ্রদ্ধাপূর্বক অনুষ্ঠিত হয়, তা সবই অসৎ এবং সে সকল ইহলোক ও পরলোকে ফলদায়ক হয়না। জয় শ্রীকৃষ্ণ ।।