সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দশম অধ্যায় - বিভূতিযোগ [সংস্কৃত ও বঙ্গানুবাদ]

দশম অধ্যায়

বিভূতিযোগ

শ্রীভগবান্ উবাচ

ভূয় এব মহাবাহো শৃণু মে পরমং বচঃ ।
যত্তেহহং প্রীয়মাণায় বক্ষ্যামি হিতকাম্যয়া ॥১॥

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে মহাবাহো ! পুনরায় শ্রবণ কর৷ যেহেতু তুমি আমার প্রিয় পাত্র, তাই তেমার হিতকামনায় আমি পূর্বে যা বলেছি, তার থেকেও উৎকৃষ্ট তত্ত্ব বলছি ।

ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষীণাং চ সর্বশঃ ॥২॥

অনুবাদঃ দেবতারা বা মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তি অবগত হতে পারে না, কেন না, সর্বতোভাবে আমিই দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ।

যো মামজমনাদিং চ বেত্তি লোকমহেশ্বরম্ ।
অসংমূঢ়ঃ স মর্ত্যেষু সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে ॥৩॥

অনুবাদঃ যিনি আমাকে জন্মরহিত, অনাদি ও সমস্ত গ্রহলোকের মহেশ্বর বলে জানেন, তিনিই কেবল মানুষদের মধ্যে মোহশুন্য হয়ে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন।

বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ ।
সুখং দুঃখং ভবোহভাবো ভয়ং চাভয়মেব চ ॥৪॥
অহিংসা সমতা তুষ্টিস্তপো দানং যশোহযশোঃ ।
ভবন্তি ভাবা ভূতানাং মত্ত এব পৃথগ্ বিধাঃ ॥৫॥

অনুবাদ (৪-৫): বুদ্ধি, জ্ঞান, সংশয় ও মোহ থেকে মুক্তি, ক্ষমা, সত্যবাদিতা, ইন্দ্রিয়-সংয্ম, মনসংযম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, সমতা, সন্তোষ, তপস্যা, দান, য্শ ও অয্শ- প্রাণিদের এই সমস্ত নানা প্রকার ভাব আমার থেকেই উৎপন্ন হয়।

মহর্ষয়ঃ সপ্ত পূর্বে চত্বারো মনবস্তথা ।
মদ্ ভাবা মানসা জাতা যেসাং লোক ইমাঃ প্রজাঃ ॥৬॥

অনুবাদঃ সপ্ত মহর্ষি, তাঁদের পূর্বজাত সনকাদি চার কুমার ও চতুর্দশ মনু, সকলেই আমার মন থেকে উৎপন্ন হয়ে আমা হতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এই জগতের স্থাবর-জঙ্গম আদি সমস্ত প্রজা তাঁরাই সৃষ্টি করেছেন।

এতাং বিভূতিং যোগং চ মম যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
সোহবিকম্পেন যোগেন যুজ্যতে নাত্র সংশয়ঃ ॥৭॥

অনুবাদঃ যিনি আমার এই বিভূতি ও যোগ যথার্থরূপে জানেন, তিনি অবিচলিতভাবে ভক্তিযোগে যুক্ত হন৷ সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে ।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ ॥৮॥

অনুবাদঃ আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন।

মচ্চিত্তা মদ্ গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্ ।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ ॥৯॥

অনুবাদঃ যাঁদের চিত্ত ও প্র্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা পরস্পরের মধ্যে আমার কথা সর্বদাই আলাচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরকে বুঝিয়ে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন।

তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্ ।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে ॥১০॥

অনুবাদঃ যাঁরা ভক্তিযোগ দ্বারা প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করে নিত্যযুক্ত, আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন।

তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ ।
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা ॥১১॥

অনুবাদঃ তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য আমি তাঁদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান-প্রদীপের দ্বারা অজ্ঞান-জনিত অন্ধকার নাশ করি।

অর্জুন উবাচ

পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্ ।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥১২॥
আহুস্তামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা ।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে ॥১৩॥

অনুবাদ (১২-১৩): অর্জুন বললেন- তুমি পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র ও পরম পুরুষ৷ তুমি নিত্য, দিব্য, আদি দেব, অজ ও বিভু। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি ঋষিরা তোমাকে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন এবং তুমি নিজেও এখন আমাকে তা বলছ।

সর্বমেতদ্ ঋতং মন্যে যন্মাং বদসি কেশব ।
ন হি তে ভগবন্ ব্যক্তিং বিদুর্দেবা ন দানবাঃ ॥১৪॥

অনুবাদঃ হে কেশব ! তুমি আমাকে যা বলেছ, তা আমি সত্য বলে মনে করি৷ হে ভগবান ! দেবতা অথবা দানবেরা কেউই তোমার তত্ত্ব য্থাযথভাবে অবগত নন।

স্বয়মেবাত্মনাত্মানং বেত্থ ত্বং পুরুষোত্তম ।
ভূতভাবন ভূতেশ দেবদেব জগৎপতে ॥১৫॥

অনুবাদঃ হে পুরুষোত্তম ! হে ভূতভাবন ! হে ভূতেশ ! হে দেবদেব ! হে জগৎপতে ! তুমি নিজেই তোমার চিৎশক্তির দ্বারা তোমার ব্যক্তিত্ত্ব অবগত আছ।

বক্তুমর্হস্যশেষেণ দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ ।
যাভির্বিভূতিভির্লোকানিমাংস্ত্বং ব্যাপ্য তিষ্ঠসি ॥১৬॥

অনুবাদঃ তুমি যে বিভূতির দ্বারা এই লোক সমূহে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছ, সেই সমস্ত তোমার দিব্য বিভূতি সকল তুমিই কেবল বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে সমর্থ।

কথং বিদ্যামহং যোগিংস্ত্বাং সদা পরিচিন্তয়্ন্ ।
কেষু কেষু চ ভাবেষু চিন্ত্যোহসি ভগবন্ময়া ॥১৭॥

অনুবাদঃ হে যোগেশ্বর ! কিভাবে সর্বদা তোমার চিন্তা করলে আমি তোমাকে জানতে পারব ? হে ভগবান ! কোন্ কোন্ বিবিধ আকৃতির মাধ্যমে আমি তোমাকে চিন্তা করব ?

বিস্তরেণাত্মনো যোগং বিভূতিং চ জনার্দন ।
ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তির্হি শৃণ্বতো নাস্তি মেহমৃতম্ ॥১৮॥

অনুবাদঃ হে জনার্দন ! তোমার যোগ ও বিভূতি বিস্তারিতভাবে পুনরায় আমাকে বল৷ কারণ তোমার উপদেশামৃত পান করে আমার পরিতৃপ্তি হচ্ছে না; আমি আরও শ্রবণ করতে ইচ্ছা করি।

শ্রীভগবানুবাচ

হন্ত তে কথয়িষ্যামি দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ ।
প্রাধান্যতঃ কুরুশ্রেষ্ঠ নাস্ত্যন্তো বিস্তরস্য মে ॥১৯॥

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন, আমার দিব্য প্রধান প্রধান বিভূতিসমূহ তোমাকে বলব, কিন্তু আমার বিভূতিসমূহের অন্ত নেই।

অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ ।
অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ ॥২০॥

অনুবাদঃ হে গুড়াকেশ ! আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা, আমিই সর্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্ত।

আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিংশুমান্ ।
মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী ॥২১॥

অনুবাদঃ আদিত্যদের মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে আমি কিরণশালী সূর্য, মরুতদের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র।

বেদানাং সামবেদোহস্মি দেবানামস্মি বাসবঃ ।
ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চাস্মি ভূতানামস্মি চেতনা ॥২২॥

অনুবাদঃ সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ, সমস্ত দেবতাদের মধ্যে আমি ইন্দ্র, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমি মন এবং সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে আমি চেতনা।

রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্ ।
বসূনাং পাবকশ্চাস্মি মেরুঃ শিখরিণামহম্ ॥২৩॥

অনুবাদঃ রুদ্রদ্রের মধ্যে আমি শিব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে আমি কুবের, বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি এবং সমস্ত পর্বতসমূহের মধ্যে আমি সুমেরু।

পুরোধসাং চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্ ।
সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ ॥২৪॥

অনুবাদঃ হে পার্থ ! পুরোহিতদের মধ্যে আমি প্রধান বৃহস্পতি, সেনাপতিদের মধ্যে আমি কার্তিক এবং জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর।

মহর্ষীণাং ভৃগুরহং গিরামস্ম্যেকমক্ষরম্ ।
যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোহস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ ॥২৫॥

অনুবাদঃ মহর্ষিদের মধ্যে আমি ভৃগু, বাক্যসমূহের মধ্যে আমি ওঁকার৷ যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে আমি হিমালয়।

অশ্বথঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাং চ নারদঃ ।
গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ ॥২৬॥

অনুবাদঃ সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বথ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ৷ গন্ধর্বদের মধ্যে আমি চিত্ররথ এবং সিদ্ধদের মধ্যে আমি কপিল মুনি।

উচ্চৈঃশ্রবসমশ্বানাং বিদ্ধি মামমৃতোদ্ ভবম্ ।
ঐরাবতং গজেন্দ্রাণাং নরাণাং চ নরাধিপম্ ॥২৭॥

অনুবাদঃ অশ্বদের মধ্যে আমাকে সমুদ্র-মন্থনের সময় উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবা বলে জানবে ৷ শ্রেষ্ঠ হস্তীদের মধ্যে আমি ঐরাবত এবং মনুষ্যদের মধ্যে আমি সম্রাট।

আয়ুধানামহং বজ্রং ধেনূনামস্মি কামধুক্ ।
প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণামস্মি বাসুকীঃ ॥২৮॥
অনন্তশ্চাস্মি নাগানাং বরুণো যাদসামহম্ ।
পিতৃণামর্যমা চাস্মি যমঃ সংযমতামহম্ ॥২৯॥

অনুবাদ (২৮-২৯): সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে আমি বজ্র, গাভীদের মধ্যে আমি কামধেনু ৷সন্তান উৎপাদনের কারণ আমিই কামদেব এবং সর্পদের মধ্যে আমি বাসুকি। সমস্ত নাগদের মধ্যে আমি অনন্ত এবং জলচরদের মধ্যে আমি বরুণ৷ পিতৃদের মধ্যে আমি অর্যমা এবং দণ্ডদাতাদের মধ্যে আমি যম।

প্রহ্লাদশ্চাস্মি দৈত্যানাং কালঃ কলয়তামহম্ ।
মৃগাণাং চ মৃগেন্দ্রোহহং বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্ ॥৩০॥

অনুবাদঃ দৈত্যদের মধ্যে আমি পহ্লাদ, বশীকারীদের মধ্যে আমি কাল, পশুদের মধ্যে আমি সিংহ এবং পক্ষীদের মধ্যে আমি গরুড়।

পবনঃ পবতামস্মি রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্ ।
ঝষাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী ॥৩১॥

অনুবাদঃ পবিত্রকারী বস্তুদের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি পরশুরাম, মৎস্যদের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা।

সর্গাণামাদিরন্তশ্চ মধ্যং চৈবাহমর্জুন ।
আধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাং বাদঃ প্রবদতামহম্ ॥৩২॥

অনুবাদঃ হে অর্জুন ! সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে আমি আদি, অন্ত ও মধ্য৷ সমস্ত বিদ্যার মধ্যে আমি অধ্যাত্মবিদ্যা এবং তার্কিকদের বাদ, জল্প ও বিতণ্ডার মধ্যে আমি সিন্ধান্তবাদ।

অক্ষরাণামকারোহস্মি দ্বন্দ্বঃ সামাসিকস্য চ।
অহমেবাক্ষয়ঃ কালো ধাতাহং বিশ্বতোমুখঃ ॥৩৩॥

অনুবাদঃ সমস্ত অক্ষরের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমাস, সংহারকারীদের মধ্যে আমি মহাকাল রুদ্র এবং স্রষ্টাদের মধ্যে আমি ব্রহ্মা।

মৃত্যুঃ সর্বহরশ্চাহমুদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম্ ।
কীর্তিঃ শ্রীর্বাক্ চ নারীণাং স্মৃতির্মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা ॥৩৪॥

অনুবাদঃ সমস্ত হরণকারীদের মধ্যে আমি সর্বগ্রাসী মৃত্যু, ভাবীকালের বস্তুসমূহের মধ্যে আমি উদ্ভব ৷ নারীদের মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা ।

বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়ত্রী ছন্দসামহম্ ।
মাসানাং মার্গশীর্ষোহহ্ মৃতূনাং কুসুমাকরঃ ॥৩৫॥

অনুবাদঃ সামবেদের মধ্যে আমি বৃহৎসাম এবং ছন্দসমূহের মধ্যে আমি গায়ত্রী, মাসসমূহের মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ এবং ঋতুদের মধ্যে আমি বসন্ত।

দ্যুতং ছলয়তামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্ ।
জয়োহস্মি ব্যবসায়োহস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতামহম্ ॥৩৬॥

অনুবাদঃ সমস্ত বঞ্চনাকারীদের মধ্যে আমি দ্যূতক্রীড়া এবং তেজস্বীদের মধ্যে আমি তেজ। আমি বিজয়, আমি উদ্যম এবং বলবানদের মধ্যে আমি বল।

বৃঞ্চীনাং বাসুদেবোহস্মি পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ ।
মুনীনামপ্যহং ব্যাসঃ কবীনামুশনাঃ কবিঃ ॥৩৭॥

অনুবাদঃ বৃঞ্চিদের মধ্যে আমি বাসুদেব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে আমি অর্জুন ৷ মুনিদের মধ্যে আমি ব্যাস এবং কবিদের মধ্যে আমি শুক্রাচার্য।

দণ্ডো দময়তামস্মি নীতিরস্মি জিগীষতাম্ ।
মৌনং চৈবাস্মি গুহ্যানাং জ্ঞানং জ্ঞানবতামহম্ ॥৩৮॥

অনুবাদঃ দমনকরীদের মধ্যে আমি দণ্ড এবং জয় অভিলাষীদের মধ্যে আমি নীতি ৷ গুহ্য ধর্মের মধ্যে আমি মৌন এবং জ্ঞানবানদের মধ্যে আমিই জ্ঞান।

যচ্চাপি সর্বভূতানাং বীজং তদহমর্জুন ।
ন তদস্তি বিনা যৎ স্যান্ময়া ভূতং চরাচরম্ ॥৩৯॥

অনুবাদঃ হে অর্জুন ! যা সর্বভূতের বীজস্বরূপ তাও আমি, যেহেতু আমাকে ছাড়া স্থাবর ও জঙ্গম কোন বস্তুরই অস্তিত্ত্ব থাকতে পারে না।

নান্তোহস্তি মম দিব্যানাং ,বিভূতীনাং পরন্তপ ।
এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো বিভূতের্বিস্তরো ময়া ॥৪০॥

অনুবাদঃ হে পরন্তপ ! আমার দিব্য বিভুতি-সমূহের অন্ত নেই ৷ আমি কেবল এই সমস্ত বিভূতির বিস্তার সংক্ষেপে বললাম।

যদ্ যদ্বিভূতীমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা ।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্ ॥৪১॥

অনুবাদঃ ঐশ্বর্য্যযুক্ত, শ্রী-সম্পন্ন ও বল-প্রভাবাদির আধিক্যযুক্ত যত বস্তু আছে, সে সবই আমার তেজাংশসম্ভূত বলে জানবে।

অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন।
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ॥৪২॥

অনুবাদঃ হে অর্জুন ! অথবা এই প্রকার বহু জ্ঞানের দ্বারা তোমার কি প্রয়োজন ? আমি আমার এক অংশের দ্বারা সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থিত আছি।

ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে ‘বিভূতিযোগো’ নাম দশমোঽধ্যায়ঃ

🙏

শ্রীমদ্ভগবত গীতার দশম অধ্যায় – বিভূতিযোগ এর সার-সংক্ষেপ

গীতার দশম অধ্যায়টির নাম বিভূতিযোগ। বিভূতি শব্দের অর্থ প্রকাশ। ভগবানের বিভূতি মানে ভগবানের অলৌকিক শক্তির নানারূপ প্রকাশ। এই অধ্যায়ের মূখ্য আলোচ্য বিষয়টিই হচ্ছে ভগবানের বিভূতি। তাই ইহা বিভূতিযোগ নামে অভিহিত। অধ্যায়টি শুরু হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের উক্তি দিয়েঁই। তিনি অর্জুনের হিতার্থে তাঁর পরম রহস্যময় প্রভাব সম্পর্কে অধিক কিছু বলবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। তিনি বললেন, তাঁর প্রভাব বা উৎপত্তির বিষয়ে মনুষ্যগণ তো বটেই, এমনকি দেবগণ ও জ্ঞাত নহেন। কারণ, তিনি দেব ও মহর্ষিগণেরও আদিকারণ। বস্তুত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত জগতেরই উৎপত্তির কারণ এবং তাঁর থেকেই সমগ্র জগৎ প্রবর্তিত হয়। কাজেই জ্ঞানী ভক্তগণ ইহা জেনে তাকে ভজনা করেন। যারা আত্মসমর্পণপূর্বক তাঁর ভজনা করেন, তিনি তাদেরকে সৎ বুদ্ধি প্রদান করেন এবং তাদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দেন যাতে সেই আলোকে ভক্ত তাঁকেই লাভ করতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ সমীপে এত কিছু শ্রবণ করে অর্জুন বললেন যে, তাঁর কথায় তার মোহান্ধকার দূরীভূত হয়েছে বটে কিন্তু তাঁর বিভূতির বিষয়ে জানবার একান্ত বাসনা জেগেছে। তখন অর্জুনের এ বাসনা পূরণার্থে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অনন্ত বিভূতির কথা বলতে লাগলেন। ভগবান তাঁর অনন্ত বিভূতি সম্পর্কে অর্জুনকে যা বলেছেন তার মর্মার্থ করলে এটাই দাঁড়ায় যে, এ জগতে যা কিছু বৃহৎ, মহৎ, মহান, বিশাল, গুণবান, কল্যাণকর ও সুন্দর তার মধ্যেই তাঁর বিভূতি। ঈশ্বর আছেন বলেই জগতটাকে এত সুন্দর লাগে, সর্বভূতে তিনি অন্তরাত্মারূপে বিরাজমান বলেই জগতের নর-নারী, বৃক্ষলতা, পশু-পাখী- সবই মনোরম ও আকর্ষণীয়। প্রেমময় ভগবানের উপস্থিতির কারণেই সর্বভূতে প্রেমের সম্পর্ক চিরন্তর বিদ্যমান এবং এই প্রেম ও ভালবাসা জগত সংসারকে সুখ, আনন্দ ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করছে। অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই তাঁর অনন্ত বিভূতির উপসংহার টেনে অর্জুনকে বললেন, শুধু এটুকুই তার জানা প্রয়োজন যে তিনি তাঁর একাংশ মাত্র দ্বারা সমস্ত জগতকে ধারণ করে অবস্থিত আছেন। এভাবেই এ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অনন্ত বিভূতির কথা ব্যক্ত করলেন শ্রীমান অর্জুনের সমীপে। জয় শ্রীকৃষ্ণ ।।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ত্রয়োদশ অধ্যায় - ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ [সংস্কৃত ও বঙ্গানুবাদ]

ত্রয়োদশ অধ্যায় ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ অর্জুন উবাচ প্রকৃতিং পুরুষং চৈব ক্ষেত্রং ক্ষেত্রজ্ঞমেব চ । এতদ্ বেদিতু্মিচ্ছামি জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চ কেশব ॥১॥ অনুবাদঃ অর্জুন বলিলেন- হে কেশব! আমি প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয়- এই সমস্ত তত্ত্ব জানতে ইচ্ছা করি। শ্রীভগবানুবাচ ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রমিত্যভিধীয়তে । এতদ্ যো বেত্তি তং প্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্বিদঃ ॥২॥ অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে কৌন্তেয় ! এই শরীর ক্ষেত্র নামে অভিহিত এবং যিনি এই শরীরকে জানেন, তাঁকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলা হয়। ক্ষেত্রজ্ঞং চাপি মাং বিদ্ধি সর্বক্ষেত্রেষু ভারত । ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োর্জ্ঞানং যত্তজ্ জ্ঞানং মতং মম ॥৩॥ অনুবাদঃ হে ভারত ! আমাকেই সমস্ত ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ বলে জানবে এবং ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ সম্বন্ধে যে জ্ঞান, সেই জ্ঞানই আমার অভিমত। তৎ ক্ষেত্রং যচ্চ যাদৃক্ চ যদ্বিকারি যতশ্চ যৎ । স চ যো যৎপ্রভাবশ্চ তৎ সমাসেন মে শৃণু ॥৪॥ অনুবাদঃ সেই ক্ষেত্র কি, তার কি প্রকার, তার বিকার কি, তা কার থেকে উৎপন্ন হয়েছে, সেই ক্ষেত্রজ্ঞের স্বরূপ কি এবং তার প্রভাব কি, সেই সব সংক্ষেপে আমার কাছে শ্রবণ কর। ঋষিভির্বহু...

সপ্তদশ অধ্যায় - শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ [সংস্কৃত ও বঙ্গানুবাদ]

সপ্তদশ অধ্যায় শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ অর্জুন উবাচ যে শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।  তেষাং নিষ্ঠা তু কা কৃষ্ণ সত্ত্বমাহো রজস্তমঃ।।১।। অনুবাদঃ  অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ! যারা শাস্ত্রীয় বিধান পরিত্যাগ করে শ্রদ্ধা সহকারে দেব-দেবীর পূজা করে, তাদের সেই নিষ্ঠা কি সাত্ত্বিক, রাজসিক না তামসিক?।

প্রথম অধ্যায় - অর্জুনবিষাদ যোগ [সংস্কৃত ও বঙ্গানুবাদ]

প্রথম অধ্যায় অর্জুন বিষাদ যোগ ধৃতরাষ্ট্র উবাচ ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ । মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয় ॥১॥ অনুবাদ : ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন- হে সঞ্জয় ! ধর্মক্ষেত্রে যুদ্ধ করার মানসে সমবেত হয়ে আমার পুত্র এবং পান্ডুর পুত্রেরা তারপর কি করল ?